।।হৃদরোগ প্রতিরোধে যা করবেন।।

খাদ্য ও পুষ্টি রোগব্যাধি স্বাস্থ্য টিপস স্বাস্থ্য সংবাদ

২১ মে ২০১৯ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি সংখ্যা অনু্সারে, এদেশে হৃদরোগীর সংখ্যা ২০ বছরে ২০ গুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর হার। আক্রান্তদের মধ্যে নারীর হার বেশি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় কর্মক্ষম বয়সে অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। কিছু বিষয় যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, তবে হৃদরোগের জন্য বেশ কয়েকটি মূল ঝুঁকির কারণ জীবনযাত্রার পছন্দগুলোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

সুসংবাদটি হলো, যদিও জিনেটিক্সের মাধ্যমে আপনার পিতামাতার কাছ থেকে কিছু সমস্যা চলে আসতে পারে, স্বাস্থ্যকর বাছাই করা আপনার কিছু রোগ হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করতে পারে।

হৃদরোগ হওয়ার অসুবিধাগুলো কমাতে আপনি যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারেন:

ধূমপান ও তামাক ব্যবহার করবেন না সিগারেট এবং তামাক জাতীয় দ্রব্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান হৃদরোগ এবং ক্যানসারের কারণ হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে সিগারেটের ধোঁয়া আপনার হৃদয় এবং রক্তনালীগুলোকে সংকীর্ণ করে এবং রক্তের পক্ষে আপনার অঙ্গে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করতে শক্ত করে তোলে। আপনার হৃদয়কে সুস্থ রাখার জন্য ধূমপান ত্যাগ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ধূমপান ছেড়ে দিয়ে আপনি পঞ্চাশ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেন।

চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিহাইপারটেনশন ওষুধ মিস করবেন না এটি আজীবন রোগ, যাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক পরিসরের উপরে থাকে তাদের উচ্চ রক্তচাপ বলে মনে করা হয়। এর ফলে হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকের চেয়ে শক্ত পাম্প দেয়, যা রক্ত দিয়ে দেহে প্রবেশ করে। উচ্চ রক্তচাপের কোনও সতর্কতা সংকেত নেই, তাই প্রত্যেকেরই রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।

শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বাড়িয়ে, স্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন ধরে রাখার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করা যায়। নিয়মিত রক্তচাপের স্ক্রিনিংগুলি সাধারণত ৩০ বছর বয়সে শুরু হয়, তবে যদি আপনার হাইপারটেনশনের পারিবারিক ইতিহাস থাকে তবে আপনার তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করা উচিত। আপনি যদি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করেন, তবে এটি স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা কিডনি রোগের কারণ হতে পারে। সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনে প্রায় ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন প্রতিদিন নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করা আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। যখন আপনি শারীরিক ক্রিয়াকলাপকে যেমন স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার মতো অন্যান্য জীবনধারা ব্যবস্থার সাথে একত্র করেন, তখন সুফল আরও বেশি হয়। শারীরিক ক্রিয়াকলাপ আপনাকে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং আপনার হৃদয়কে উচ্চ চাপ দিতে পারে এমন উচ্চ অবস্থার যেমন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিসের মতো পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা হ্রাস করতে সহায়তা করে।

অনুশীলন রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে, ক্যালোরি পোড়ায় এবং কোলেস্টেরলের জটিলতা রোধ করতে সহায়তা করে। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ স্ট্রেস থেকে মুক্তিও দেয় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপন্থি বায়বীয় অনুশীলন করুন। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে তিনবার অনুশীলন করুন এবং টানা দুই দিনের বেশি বিশ্রাম নেবেন না। অন্য কোনও contraindication না থাকলে পেশী শক্তিশালীকরণ ব্যায়াম প্রতি সপ্তাহে ২-৪ বার একসাথে করা উচিত।

কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার পরিহার করুন কোলেস্টেরল সর্বদা আপনার রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করার চেষ্টা করে। রক্তে খুব বেশি কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কিছু কোলেস্টেরল খাবার থেকে আসে। ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল কম খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেহে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করতে পারি। প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণত ৪০ বছর বয়সে প্রতি বছর কমপক্ষে একবার তাদের কোলেস্টেরল পরিমাপ করা উচিত।

বেশি করে আঁশযুক্ত খাবার খান যেসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ আছে, সেসব খাবার খাবেন। আঁশযুক্ত খাদ্য রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। বেশি আঁশ আছে এ রকম সবজির মধ্যে রয়েছে শিম ও মটরশুঁটি জাতীয় সবজি, কলাই ও ডাল জাতীয় শস্য এবং ফলমূল। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, আলু এবং শেকড় জাতীয় সবজি খোসাসহ রান্না করলে সেগুলো থেকেও প্রচুর আঁশ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তাঁরা হোলগ্রেইন আটার রুটি এবং বাদামি চাল খাবারও পরামর্শ দিয়েছেন।

স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা জমাট-বাঁধা চর্বি জাতীয় খাবার কমিয়ে ফেলুন খাদ্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব খাবারে বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা জমাট-বাঁধা চর্বি থাকে, সেসব খাবার খেলে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে বেড়ে যায় হৃদরোগের ঝুঁকিও। চিজ, দই, লাল মাংস, মাখন, কেক, বিস্কিট ও নারকেল তেলে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। তাঁরা বলছেন, হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে হলে স্যাচুরেটেড নয় এমন চর্বি (যেসব খাবারের উপর চর্বি জমাট বাঁধে না) সে ধরনের খাবার খেতে হবে। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ, বাদাম ও বীজ। অলিভ, সানফ্লাওয়ার, ভুট্টা এবং ওয়ালনাট তেল দিয়ে রান্নার বিষয়ে তাঁরা জোর দিয়েছেন। দুধের বেলায় স্কিমড বা সেমি-স্কিমড (দুধ থেকে চর্বি সরিয়ে নেওয়া) দুধ খেতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে খাবারে যাতে বাইরে থেকে চিনি মেশানো না থাকে। লাল মাংসের বদলে খেতে হবে মুরগির মাংস। মুরগির চামড়া তুলে ফেলে দিন। গরুর মাংস খেলে তার উপর থেকে চর্বি ফেলে দিয়ে রান্না করতে হবে।

সপ্তাহে অন্তত একদিন এমন মাছ খেতে হবে যাতে প্রচুর তেল আছে। ক্রিস্প ও বিস্কিটের বদলে নানা ধরনের বাদাম ও বীজ খেতে পারেন। লবণকে বিদায় জানান লবণ বেশি খেলে শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এর ফলে বৃদ্ধি পায় হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও। খাওয়ার সময় পাতে আলগা লবণ খাবেন না এবং খাবার টেবিলে লবণদানি রাখবেন না। লবণ কাঁচা হোক বা ভাজা হোক উভয়ই ক্ষতিকর। ব্রিটেনে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয় যে এনএইচএস থেকে, তাঁদের পরামর্শ হলো দিনে সর্বোচ্চ ৬ গ্রাম (এক চা চামচ পরিমাণ) লবণ খাওয়া যেতে পারে। তারা বলছেন, লবণ কম-বেশি খাওয়া একটি অভ্যাসের ব্যাপার। লবণ যত কম খাওয়া হবে, তার চাহিদাও তত কমে যাবে। এই অভ্যাস বদলাতে মাত্র চার সপ্তাহের মতো সময় লাগে। এই সময় পর দেখা যাবে আপনি যে খাবারের সাথে লবণ খাচ্ছেন না, সেটি আপনি বুঝতেই পারবেন না। খাদ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন, লবণের পরিবর্তে মশলা দিয়ে খাবার প্রস্তুত করলে তা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাবে।

ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাবেন যেসব খাবারে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ বেশি থাকে, সেগুলো আমাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। শুধু তা-ই নয়, এসব খাবার হৃদরোগের ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে। হৃদরোগের যেসব কারণ আছে সেগুলো ঠেকাতেও এসব খনিজ ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। অনেক খাদ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ ডায়েটের মাধ্যমেই এসব ভিটামিন ও খনিজ পাওয়া সম্ভব। এসবের জন্যে ট্যাবলেটের ওপর নির্ভর করতে হবে না। তবে তার মধ্যে ব্যতিক্রম হচ্ছে ভিটামিন ডি। কারও শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব থাকলে যেসব খাবার খাওয়া প্রয়োজন : প্রতিদিন পরিমিত ফল বা সবজি খাওয়া । শিম ও ডাল জাতীয় শস্যও খেতে পারেন। বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবারে থাকে ভিটামিন ই। মাছ, দুগ্ধজাত খাবার ও হোলগ্রেইনে পাওয়া যায় ভিটামিন বি। কলা, আলু এবং মাছে পটাশিয়াম। ডাল ও হোলগ্রেইনে ম্যাগনেসিয়াম। দুগ্ধজাত খাবার ও সবুজ পাতার সবজি থেকে পাওয়া যায় ক্যালসিয়াম।

পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে এবং মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। যেসব ব্যক্তি পর্যাপ্ত ঘুমায় না, তাদের স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং হতাশার ঝুঁকি বেশি থাকে। কিছু লোক অস্বাস্থ্যকর উপায়ে স্ট্রেস সহ্য করে; যেমন অতিরিক্ত খাওয়া, মদ্যপান বা ধূমপান। শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, শিথিলকরণ অনুশীলন বা ধ্যানের মতো চাপকে পরিচালনা করার বিকল্প উপায় সন্ধান করা আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে। আপনার যদি উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতো অবস্থা থাকে, তবে আপনার ডাক্তার জীবনযাত্রা পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে পারেন। আপনার চিকিৎসা যেমন আপনার ডাক্তার নির্ধারিত করে সেগুলো গ্রহণ করে নিশ্চিত করুন এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা পরিকল্পনা অনুসরণ করুন।

লেখকঃ মোঃ আরিফুজ্জামান রাজা

৫ম ব্যাচ ৪র্থ বর্ষ, ১ম সেমিস্টার ২০১৭/২০১৮ সেশন

ফার্মেসী বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *