ধমনি ( Artery) ও শিরা’র( Vein) মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত চলাচল করে। দেহের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত চলাচলের সময় ধমনি ও শিরার প্রাচীরে যে চাপের অনুভূত হয় তাকে রক্ত চাপ বা রক্তের চাপ ( Blood Pressure) বলে। মনে রাখতে হবে, সুস্থ দেহে ধমনি ও শিরায় স্বাভাবিক রক্ত চাপ মেইনটেইন হয়। স্বাভাবিক রক্ত চাপ আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্বাভাবিক রক্ত চলাচলের মাধ্যমে অক্সিজেন ও নিউট্রিয়েন্টস আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পৌছায়। যদি কোনো কারণে ধমনি ও শিরার প্রাচীরে স্বাভাবিক রক্ত চাপের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে আমাদের শরীরে অস্বাভাবিক রক্ত চাপের ( উচ্চ রক্ত চাপ বা নিম্ন রক্ত চাপ) দেখা মেলে। অনিয়ন্ত্রিত রক্ত চাপে ( উচ্চ রক্ত চাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার) শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অঙ্গ যেমন হৃদপিন্ড ( Heart), কিডনি ( Kidney) এবং চোখে ( Eye) জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
[ “বাংলাদেশ জনমিতি স্বাস্থ্য জরিপ “এর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি চার জনের একজন উচ্চ রক্তচাপ-জনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন।]
#সাধারণত_দুটি_মানের_মাধ্যমে_রক্তচাপ_রেকর্ড_করা_হয় –
সিস্টোলিক প্রেসারঃ হৃদপিন্ডের প্রতিটি হৃদস্পন্দের সময় এটি সংকুচিত হয় আর এই চাপে রক্ত ধমনীর মাধ্যমে সমগ্র দেহে ছড়িয়ে পরে। হৃদপিন্ডের এ চাপকে সিস্টোলিক চাপ বলে। রক্ত চাপের দুটি সংখ্যার ( Systolic and diastolic) মধ্যে এটি বেশি।
ডায়াস্টলিক প্রেসারঃ দুটি হৃৎস্পন্দনের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড যখন শিথিল থাকে, সে সময়ে ধমনির গায়ে রক্তের যে চাপ বিরাজমান থাকে, সেটাই ডায়াস্টোলিক প্রেশার। এটি কম সংখ্যাটি নির্দেশ করে৷ যেমনঃ আমাদের শরীরে নরমাল ব্লাড প্রেসার হচ্ছে ১২০/৮০ মি.মি-মার্কারি (mm-Hg)।এখানে ১২০ মি.মি-মার্কারি চাপকে সিস্টোলিক চাপ আর ৮০ মি.মি-মার্কারি চাপকে ডায়াস্টলিক চাপ বলে।
#রক্তের_চাপ:
স্বাভাবিক রক্ত চাপ ( Normal Blood Pressure) : একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্ত চাপ ১২০/৮০ মি.মি-মার্কারি। রক্ত চাপের এই রিডিং-কে স্বাভাবিক রক্ত চাপ বলা হয়৷
উচ্চ রক্ত চাপ ( High Blood Pressure) : রক্ত চাপ ১৪০/৯০ মি.মি-মার্কারি বা এর চেয়েও বেশি হলে তাকে উচ্চ রক্ত চাপ বলে।
নিম্ন রক্ত চাপ ( Low Blood Pressure) : রক্ত চাপের রিডিং যদি ৯০/৬০ মি.মি-মার্কারি বা এর আশেপাশে থাকে তাহলে তা লো ব্লাড প্রেসার হিসেবে ধরা হয়।
[বয়স এবং শরীরের গাঠনিক অনুযায়ী রক্তচাপ কিছুটা কম বেশি হতে পারে ]
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের কারণ নির্দিষ্ট করে জানা যায় না।যাদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণ নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব হয় না, তাদের ক্ষেত্রে সেটিকে প্রাইমারি বা এসেনশিয়াল ব্লাড প্রেশার বলা হয় । অনেক সময় উচ্চ রক্ত চাপের কোনো লক্ষণ না থাকায় দীর্ঘ সময় চিকিৎসার অভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে এবং রোগী হয়তো বুঝতেই পারেন না যে তার মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। আর এ কারণেই উচ্চ রক্ত চাপকে শরীরের জন্য নিরব ঘাতক বলা হয়ে থাকে।
#উচ্চ_রক্তচাপের_লক্ষণসমূহ: উচ্চ রক্ত চাপের একেবারে সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষণ সেভাবে প্রকাশ পায় না। তবে সাধারণ কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে:
প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করা, মাথা গরম হয়ে যাওয়া এবং মাথা ঘোরানো।
ঘাড় ব্যথা করা।
বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
অল্পতেই রেগে যাওয়া বা অস্থির হয়ে শরীর কাঁপতে থাকা।
রাতে ভালো ঘুম না হওয়া।
মাঝে মাঝে কানে শব্দ হওয়া।
অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা।
#উচ্চ_রক্ত_চাপের_কারণ:
সাধারণত মানুষের ৪০ বছরের পর থেকে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।
পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে।
নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করে অলস জীবনযাপন করলে।
প্রতিদিন ছয় গ্রাম অথবা এক চা চামচের বেশি লবণ খেলে।
ধূমপান বা মদ্যপান বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য/পানীয় খেলে।
দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যা হলে।
শারীরিক ও মানসিক চাপ থাকলে।
#উচ্চ_রক্ত_চাপ_প্রতিরোধে_যা_করণীয়.. জীবনযাপনে পরিবর্তন আর নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এজন্য কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে:
খাবারে লবণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া – লবণের সোডিয়াম রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়, ফলে রক্তের আয়তন ও চাপ বেড়ে যায়।
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা – ধূমপান শরীরে নানা ধরণের বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, ফলে ধমনী ও শিরার নানারকম রোগ-সহ হৃদরোগ দেখা দিতে পারে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করা – শরীরের ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে হৃদযন্ত্রের অতিরিক্ত পরিশ্রম হয়। বেশি ওজনের মানুষের মধ্যে সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা যায়।
নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম করা – নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম করলে হৃৎপিণ্ড সবল থাকে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। যার ফলে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা কম করা – রাগ, উত্তেজনা, ভীতি অথবা মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘসময় ধরে মানসিক চাপ অব্যাহত থাকলে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা – মাংস, মাখন বা তেলে ভাজা খাবার, অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার খেলে ওজন বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত কোলেস্টোরেল যুক্ত খাবার খাওয়ার কারণেও রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। কারণ, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টোরেল রক্তনালীর দেয়াল মোটা ও শক্ত করে ফেলে। এর ফলেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা যেতে পারে।
#উচ্চ_রক্ত_চাপ_নিয়ন্ত্রণে_ব্যবহৃত_কিছু_ওষুধ:
বিটা-ব্লকারস্: Atenolol, Bisoprolol,Propranolol, Metoprolol: হার্ট-এর বিটা রিসেপ্টর ব্লক করার মাধ্যমে রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
আলফা-ব্লকারস্: Prazosin, Terazosin : ধমনি ও শিরায় অবস্থিত আলফা রিসেপ্টার ব্লক করায় ধমনি ও শিরা’র প্রসারণ ঘটে যার কারণে রক্ত চাপ কমে যায়৷
ACE ( Angiotensin Converting Enzyme) ইনহিবিটরস্: Captopril, Lisinopril, Enalapril,Ramipril: উচ্চ রক্ত চাপের জন্য দায়ী হরমোন তৈরীতে বাধা দেয়।
Angiotensin ll receptor blockers ( ARBs)- Losartan, Telmisartan,Valsartan : ধমনি ও শিরা সংকোচ হতে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ক্যালসিয়াম-চ্যানেল ব্লকারস্ : Amlodipine, Nicardipine, Nifedipine) – হার্ট কোষের(Heart cell) ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লক করার মাধ্যমে হার্ট_এর সঞ্চালন ( সংকোচন) কমানো হয়। এতে শরীরে রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রিত হয়।
ডাই-ইউরেটিকস্ (Diuretics) : Furosemide, chlorthiazide, Amiloride, Spironolactone, Triamterene : শরীর থেকে লবণ ও পানি বের করে দেয়। এতে রক্তের আয়তন কমে যাওয়ার মাধ্যমে শরীরে উচ্চ রক্ত চাপ মেইনটেইন হয়।
#লেখক: আরমান ইসলাম রোমান
শিক্ষার্থী: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ফার্মেসি ডিপার্টমেন্ট।