ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র

খাদ্য ও পুষ্টি রোগব্যাধি স্বাস্থ্য টিপস স্বাস্থ্য সংবাদ

আজকাল ডায়াবেটিস শব্দটি সবার মুখে মুখে উচ্চারিত বেশ পরিচিত একটি শব্দ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে এমন একটি পরিবার খুঁজে পাওয়া খুবই দুঃসাধ্যকর যেখানে ডায়াবেটিস এর একটি রোগী পাওয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যত দিন যাচ্ছে ডায়াবেটিস রোগটি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি ঘরে ঘরে। আজকে আমরা কথা বলবো কিভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে শুরুতেই ডায়াবেটিস সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাক–
ডায়াবেটিস কী??
ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ। যার কারণে আমাদের শরীরে ইনসুলিন এর পরিমাণ কমে যায় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাএা বাড়তে থাকে। ফলে দেহে বিভিন্ন রকমের জটিলতা যেমনঃ হার্ট ডিজিজ, কিডনি প্রবলেম, চোখের এূটি দেখা দেয়।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদঃ
ডায়াবেটিসের তিনটি প্রধান প্রকার রয়েছে:
টাইপ 1 ডায়াবেটিস ,
টাইপ 2 এবং
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ( গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস )।
টাইপ- 1 ডায়াবেটিসঃ
টাইপ 1 ডায়াবেটিস একটি অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ইনসুলিন তৈরি করা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।টাইপ 1 ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি প্রায়শই দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এটি সাধারণত শিশু, কিশোর এবং অল্প বয়স্কদের মধ্যে নির্ণয় করা হয়। আপনার যদি টাইপ 1 ডায়াবেটিস থাকে তবে আপনাকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হবে।ডায়াবেটিস আছে এমন প্রায় 5-10% লোকের টাইপ 1 আছে।
টাইপ 2 ডায়াবেটিসঃ
টাইপ 2 ডায়াবেটিসের রোগীদের শরীর ইনসুলিন ভালভাবে ব্যবহার এবং রক্তে শর্করাকে স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে পারে না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় 90-95% লোকের টাইপ 2 রয়েছে। এটি বহু বছর ধরে বিকাশ লাভ করে এবং সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নির্ণয় করা হয় (কিন্তু শিশু, কিশোর এবং অল্প বয়স্কদের মধ্যে বেশি বেশি)। টাইপ 2 ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যেতে পারে বা দেরি করা যেতে পারে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে, যেমন ওজন কমানো, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং শারীরিক ব্যায়াম করা।

গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিসঃ
বর্তমান সময়ে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বেশ দেখা যাচ্ছে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস; গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে যাদের কখনও ডায়াবেটিস হয়নি। যদি কোনো নারীর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকে তবে সেক্ষেত্রে শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য উচ্চ ঝুঁকি হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সাধারণত শিশুর জন্মের পরে চলে যায় কিন্তু পরবর্তী জীবনে টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া শিশুর শিশু বা কিশোর বয়সে স্থূলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং পরবর্তী জীবনেও টাইপ 2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ডায়াবেটিস কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন??
ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার পর আমরা অনেকেই ঘাবড়ে যাই এবং থাকি যে, আমার জীবনটা বুঝি শেষ এখনই। কিন্তু আসলে ডায়াবেটিস হলে ভয় পাবার কোনে কারণ নেই। এটি একটি সাধারণ রোগ। নিয়ন্ত্রণে রাখলে এটি আপনার জীবন যাএায় কেনোরূপ ব্যাঘাত ঘটাবে না। এমনকি বাকি আট-দশ জন মানুষের মতো আপনিও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে আপনার ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত রাখা মানে কী?
ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত রাখ মানে হচ্ছে খালি পেটে আপনার ডায়াবেটিস এর মাএা বা রক্তে গ্লুকোজের মাএা ৬ মি লি এর নিচে এবং খাবার ২ ঘন্টা পরে ৮ মিলি এর নিচে থাকতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আপনার জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন আনতে হবে এবং সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে–
★ খাদ্যাভাস ও শরীরচর্চায়। আমদের মধ্যে অনেকেরই ধারনা করেন যে, ডায়াবেটিস হওয়া মানেই হলো কোনো কিছু খাওয়া যাবে না। তবে কথাটা কতটুকু সত্য?? চলুন ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্যাভাস নিয়ে আলোচনা করা যাক–
ডায়াবেটিস রোগীদের যে সব খাবার পরিহার করা উচিৎ —
ডায়াবেটিসের জন্য ডায়েটে কোন খাবারগুলি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত তা নির্ধারণ করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হল কোন খাবারগুলি সীমাবদ্ধ করা উচিত তা বোঝা।
★ডায়াবেটিস শব্দটির সাথে চিনির গভীরভাবে সম্পর্ক রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিনি একটি বিষের মতো কাজ করে। সুতরাং সর্বাবস্থায় চিনি এড়িয়ে চলতে হবে।
★শুধু চিনি পরিহার করলেই কিন্তু হবে না, সাথে পরিহার করতে হবে, সরল শর্করা ও।
সরল শর্করা যুক্ত খাবারের মধ্যে অনর্ভূক্তঃ

● চিনি
● মিষ্টি
● কেক
● বিস্কুট
● গুড়
● ফলের রস

এসকল খাবার খুব দ্রুত রক্তে সুগারের মাএা বাড়িয়ে দেয়। এখন এখানে অনেকেই ভাববেন যে, ডায়াবেটিস হলে হয়তো শর্করা জাতীয় খাবার একে বারেই বাদ দিতে হয়। আসলে এমনটা কিন্তু না। চলুন, তাহলে আজ তাহলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র শিখিয়ে দেই!! ডায়াবেটিস রোগীদের শর্করা জাতীয় খাবার একেবারেই বাদ দেয়া উচিত নয় বরং নিয়মিত বিরতিতে, নির্দিষ্ট মাএায় গ্রহন করা উচিত।
★ অতিরিক্ত ফ্যাট জাতীয় খাবারঃ
ঘি, মাখন, মার্জারিন, চিজ, পেস্ট্রি, তেলে ভাজা যেকোনো খাবার পরিহার করা উচিত। কেননা, এ সকল খাবার রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাএা বাড়িয়ে তোলে।
★ সফট্ ড্রিংকস
★ অ্যালকোহল।
★ ময়দা জাতীয় খাবার।
★ উচ্চ ক্যালোরি যুক্ত খাবার যেমন গরুর মাংস, ফাস্টফুড। এতে করে ওজন নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং ডায়াবেটিস এর মাএাও কমে আসবে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সেরা খাবারঃ

  1. চর্বিযুক্ত মাছঃ
    চর্বিযুক্ত মাছে ওমেগা -3 ফ্যাট থাকে যা প্রদাহ এবং হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও, এটি প্রোটিনের একটি দুর্দান্ত উৎস , যা রক্তে শর্করার ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  2. পাতাযুক্ত সবুজ শাকঃ
    পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি ভিটামিন সি এর মতো পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং সেইসাথে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা হৃৎপিন্ড এবং চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
  3. চিয়া বীজঃ
    চিয়া বীজে উচ্চ পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা আপনাকে ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে। তারা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বজায় রাখতেও সাহায্য করে।
  4. মটরশুটিঃ
    মটরশুটি সস্তা, পুষ্টিকর এবং কম গ্লাইসেমিক সূচক রয়েছে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসাবে তৈরি করে। এছাড়াও ডিমের সাদা অংশ, বাদম, অ্যাভোগেডো, ব্রকলি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

এখন আসি শারীরিক ব্যায়ামের কথায়। একমাএ এই একটি রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য শারীরিক ব্যায়ামকে চিকিৎসকগণ ঔষধের সমতুল্য ভেবে থাকেন।যখন একজন ডায়াবেটিস রোগী নিয়মিত ব্যায়াম করে তখন তারদেহের ইনসুলিনের কার্যকারীতা নিজে নিজেই কমে যায়। প্রতিটি কোষ তখন ইনসুলিনের প্রতি সেনসিটিভ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ঔষধ ছাড়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
কিভাবে ব্যায়াম করবেন?
সপ্তাহে অন্তত ৫০ মিনিট বা সপ্তাহে ০৩ দিন ১৫-২০ মিনিট ধরে হাটতে হবে এবং হাটা অবশ্যই এমন হতে হবে যে, আপনার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়। অর্থাৎ ফুসফুস ও হৃদযন্ত্র যাতে কাজ করছে সেটি আপনি বুঝতে পারেন।
ডায়াবেটিস এর ব্যায়ামের ৩ টি অংশ রয়েছে।
১. ওয়ার্ম আপ।
২. একনাগাড়ে হেটে যাওয়া
৩. কুল ডাউন।
এছাড়াও সাইকেল চালানে, সাতার কাটা এর বাইরে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে হবে। অথবা ইনসুলিন গ্রহণ করা নিয়মিত ডায়াবেটিস চেক করা।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস এর অবস্থাঃ
বাংলাদেশে প্রায় প্রতি দশজনের মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস পাওয়া গেছে, যা সম্প্রতি একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সাম্প্রতিক মেটা-বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, 1995 থেকে 2000 সালে 4% এবং 2001 থেকে 2005 সালে 5% থেকে 2006 থেকে 2010 সালে 9% হয়েছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন জানিয়েছে যে প্রকোপ 13% হবে। 2030 [8] । WHO এর মতে, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার অন্তত 2.8% ডায়াবেটিসে ভুগছে। টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ক্রমবর্ধমান হার বিবেচনা করে এটি বোঝা যায় যে, 2030 সালের মধ্যে ডায়াবেটিস
মেলিটাসের প্রাদুর্ভাব দ্বিগুণ হবে। ২০১০-২০১১ সময়কালে বাংলাদেশ ৮ম সর্বোচ্চ ডায়াবেটিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা আইসিডিডিআর, বি-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের কারণে প্রায় 129,000 মৃত্যু হয়েছে। 2025 সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। এর প্রকোপ ১৩% হবে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী:
এখন যেহেতু আপনি ডায়াবেটিস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন সেহেতু কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে যা আপনার মনের মধ্যে উকিঁ দিতে পারে। নীচে অংশে ডায়াবেটিস সম্পর্কিত সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে —
ভাত নাকি রুটি? ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কোনটি ভালো?

ভাত কিংবা রুটি- দুটিই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা খেতে পারেন। তবে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাদামি চাল ও অপরিশোধিত গমের আটা কিংবা বেসনের রুটি ডায়াবেটিকদের জন্য উপযুক্ত। আর অবশ্যই এসব শর্করা গ্রহণ পরিমান মতো খেতে হবে। বাদামি কিংবা লাল চালের ভাতে থাকে বিভিন্ন খনিজ, ভিটামিন ও আঁশ, ফলে হজম হয় দেরিতে। সাদা চালে স্টার্চ বেশি থাকে পাশাপাশি সাদা চাল পলিশ করা হয় বিধায় এর পুষ্টিগুণ হারায়। বাদামি চালের ভাতের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স’য়ের মাত্রা ৬৮ আর সাদা চালের ভাত ৭৩। অপরদিকে গমের লাল আটার রুটি জটিল শর্করা বিধায় এটি পরিপাকতন্ত্রে পরিপাক হতে বেশি সময় থাকে।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কেন ফল খাওয়া স্বাস্থ্যেকর?

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আম, কলা খুব বেশি না খাওয়াই ভালো কেননা এগুলোতে প্রচুর ক্যালরি থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিয়মিত আপেল, কমলা, পাকা পেপে খাওয়া উচিত।
ডায়াবেটিস রোগীরা কি ফলের জুস খেতে পারবে?
ডায়াবেটিস রোগীদের ফলের জুস সম্পূর্ণরুপে পরিহার করা উচিত। কেননা, এতে উচ্চ ক্যালোরি থাকে এবং নরমাল ফলের মতো ফাইবার পাওয়া যায় না।
শেষকথাঃ
গুনিপোকা যেমন ধীরে ধীরে কাঠ খেয়ে ফেলে তেমনিভাবে ডায়াবেটিস ও ধীরে ধীরে শরীরের সমস্ত অঙ্গ গুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ফেলে। কাজেই ডায়াবেটিস কে হেলাফেলা করা কোনো ভাবেই উচিত না, বরং সুনিয়ন্ত্রিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুতরাং সুশৃঙ্খল ভাবে জীবন যাপন করুন, ডায়াবেটিস মুক্ত থাকুন।

লিখেছেনঃ
Mausufa Akter
Food Technology and Nutritional Science (2nd Year)
Mawlana BhashaniScience and Technology University

3 thoughts on “ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *