“ডায়াবেটিস” শব্দটি সাম্প্রতিক সময়ে যতই না পরিচিত ডাক্তারদের কাছে তার থেকে বেশি পরিচিত সাধারণ মানুষের কাছে। উচ্চ রক্তচাপ হোক বা হৃদপিণ্ডের সমস্যা, ডাক্তারদের প্রথম প্রশ্ন “ ডায়াবেটিস আছে?” এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে এই রোগটা এতই পরিচিত যে, সামান্য অজ্ঞান হলেই ধারনা করে ফেলে তার ডায়াবেটিস আছে। এবং তারা এই ধারনা পোষন করে যে, চিনি বেশি খেলেই ডায়াবেটিস হয় তাই তারা ভয়ে চিনিই খায় না। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই এমন? কতটুকু জানি আমরা এই ডায়াবেটিস সম্পর্কে? কিন্তু আমাদের সকলেরই এই ডায়াবেটিস নামক একটা রোগ সম্পর্কে পূর্ন ধারনা রাখা দরকার।
প্রথমেই আসা যাক ডায়াবেটিস কি?
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন এর মতে, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা কখনো সারে না। কিন্তু এ রোগকে সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আইরিশ ইনডিপেনডেন্টের খবরে বলা হয়েছে, যখন আমরা কার্বোহাইড্রেট বা সাধারণ শর্করাজাতীয় খাবার খাই, তখন তা ভেঙে গ্লুকোজ এ পরিনত হয়। এবং আমাদের দেহে অগ্নাশয় থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন নামক হরমোন এই গ্লুকোজ সারাদেহের কোষে পৌঁছে দেয়।কিন্তু কোন কারনে ইনসুলিন নিঃসরন কম হওয়ার কারনে যখন এই গ্লুকোজ শরিরের কোষে পৌছাবে না তখন রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমান বেড়ে যায়, যা সাধারনত ডায়াবেটিস নামে পরিচিত।
ডায়াবেটিস এর প্রকারভেদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ডায়াবেটিস সাধারণত বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস কে সাধারণত ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ
- টাইপ ১ ডায়াবেটিসঃ কোন ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগির, ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ধাপ হলো টাইপ ১ ডায়াবেটিস। টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারণত অপ্রাপ্তবয়স্কদের বেশি হয়ে থাকে যা জুভেনাইল ডায়াবেটিস নামে পরিচিত।এই ডায়াবেটিস সাধারণত প্রথম দিকে ধরা পরে যার ফলে শরীর যে ইনসুলিন তৈরি করে তা নষ্ট হতে থাকে ফলে বাইরে থেকে ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে ইনসুলিন গ্রহনের প্রয়োজন হয়। সাধারণত ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগিদের ৫-১০% ই এই ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হয়ে থাকে।
- টাইপ ২ ডায়াবেটিসঃ এটি প্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াবেটিস। কোন টাইপ ১ ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হওয়া রোগী যদি তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে,,, যদি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন না করে এমনকি কোন রকম ঔষুধ ও গ্রহন না করে তাহলে সে টাইপ ২ ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে শরীরের ইনসুলিন হরমোন এর সাথে কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয়। সাধারণত ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত ৯০-৯৫% ই টাইপ ২ ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত, যা ডায়াবেটিস মেলিটাস নামেও পরিচিত।
- গেষ্টেশনাল ডায়াবেটিসঃ এই ডায়াবেটিস সাধারণত গর্ভবতী মহিলাদের হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের শরীরে গ্লুকোজ এর পরিমান বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিস রোগের কারনঃ
বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৭০% মানুষেরই ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। কিন্তু কোন একটি বিশেষ কারনেই যে রোগটি হয়ে থাকে এমনটি নয়।
- ডায়াবেটিস এর মূল কারন অতিরিক্ত ওজন এবং ভুরি।
- হাটাহাটি, ব্যায়াম না করা, একঘেয়েমি জীবনযাপন করা।
- বংশগত কারনে হয়ে থাকে। কারো পরিবারের কোনো সদস্যদের যদি এই রোগের পূর্ব ইতিহাস থাকে তাহলে এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বেশি।
- ৪৫ বছরের উপরে বয়স হলে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- কার যদি টাইপ ১ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে এবং সে যদি সঠিক চিকিৎসা না করায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখে তবে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিস মেলিটাস হয়।
ডায়াবেটিস এর লক্ষনঃ
ডায়াবেটিস সাধারণত সবার কাছে মুত্রবর্ধক রোগ নামেই পরিচিত। এই রোগের প্রথম এবং প্রধান লক্ষন মুত্রের পরিমান বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও শুরু থেকেই আমাদের শরিরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখানোর মাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে এবং যার মাধ্যমে রোগি সহজেই চিকিৎসার আওতায় আস্তে পারে।
যেমনঃ
- অতিরিক্ত জলের পিপাসা
- অহরহ ক্ষুধা
- অবসাদ প্রবনতা ও ক্লান্তি
- চোখ এ ঝাপসা দেখা
- ঘা শুখাতে দেরি হওয়া
তাছাড়াও কারো কারো ক্ষেত্রে,
- মেজাজ দ্রুত পরিবর্তন হওয়া
- হঠাৎ রেগে যাওয়া
- বিষন্নতা
- হাত-পা কাঁপা ইত্যাদি লক্ষন প্রকাশ পায়।
ডায়াবেটিসের জটিলতাঃ
ডায়াবেটিস আক্রান্ত রগিদের সাধারণত হৃদরোগ, হার্ট ফেইলিউর, কিডনি ফেইলিউর হওয়ার ঝুঁকি থাকে বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত না রাখলে এসব সংক্রমণ দেখা যায়।
হাইপোগ্লায়সেমিয়াঃ
হায়পোগ্লায়সেমিয়া হল ডায়াবেটিস এর একটি বিশেষ লক্ষন যখন রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যায়। এক্ষেত্রে যদি রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমান ৪ এর নিচে নেমে আসে তাহলে এই অবস্থাকে হায়পোগ্লায়সেমিয়া বলে। এবং এই অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমান কমে যাওয়ার ব্যাক্তি মাথা ঘোরানো, শরীর কাঁপুনির, চোখে ঝাপসা দেখার মতো লক্ষন প্রকাশ পায়।
ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রিত মান নির্দেশিকাঃ
কোন ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর ডায়াবেটিস সব সময় কম বেশি হতে থাকে। কিন্তু একটি সঠিক মানের মধ্যে থাকলে বোঝা যাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত আছে কি না। সাধারণত রক্তের গ্লাইক্যাটেড হিমোগ্লবিন পরিক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিস পরিক্ষা করা হয়। বর্তমানে সকল ডাক্তারের চেম্বারসহ ঘরে বসেই ডায়াবেটিস পরিক্ষা করা যায়, যার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
সাধারণত সকাল সকাল খালি পেটে রক্তের গ্লুকোজ এর মান যদি(Fasting) ৭ এর কম হয় এবং সকালের নাস্তার ২ ঘন্টা পর মান(ABF) যদি ১০ এর মধ্যে হয় এবং আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্তের গ্লুকোজ এর ৩ মাসের গড় মান (Hb1AC) যদি ৭ এর সমান বা কম হয় তাহলে বলা যাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে।
ডায়াবেটিস এর চিকিৎসাঃ
ডায়াবেটিস একটি জটিল রোগ যা কখনোই একা একা ভাল হবে না, ডাক্তারের পরামর্শ না নেয়া , খাদ্যাভাসে পরিবর্তন না আনা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এই রোগকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে এবং যার কারনে হৃদরোগ ,কিডনি তে সমস্যা সহ আরও অনেক ধরনের জটিল রোগ হতে পারে। তাই এই রোগের চিকিৎসা করা অনেক জরুরি।
- ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় প্রথমেই চিনি খাওয়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সাথে সাথে ব্যায়াম, যগের মতো শারীরিক কার্যকলাপে অংশ নিতে হবে।
- রক্তে গ্লুকোজ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা দেখার জন্য প্রতিদিন বা সপ্তাহে ২/৩ দিন ব্লাড সুগার মাপতে হবে।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ধরনের ঔষুধ যেমন মেটাফরমিন, সিমলিন, সালফোনাইরিওলিয়াস ইত্যাদি ঔষধ গ্রহন করতে হবে।
- রোগীর পা সাবধানে রাখতে হবে যেন কোন ধরনের আঘাত না লাগে।
- টাইপ ১ ও টাইপ ২ রোগীদের চোখের ছানি, রেটিনা পরিক্ষা করাতে হবে।
ডায়াবেটিস এর প্রতিরোধ ব্যাবস্থাঃ
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
- পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করা
- ব্যায়াম, খেলাধুলা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা
- তামাক, বিড়ি, সিগারেট, অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য পরিহার করা
- ফাস্টফুড, বেশি মশলা এবং তেল জাতীয় খাবার কম খাওয়া
সুতরাং, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা পুরোপুরি ভাল না হলেও একে সহজে নিয়ন্ত্রণে রেখে সুখি জীবনযাপন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু একটু সতর্কতা, নিয়ম মেনে চলা, ব্যায়াম করা, সঠিক সময়ে পরিমান মতো খাবার খাওয়া। তাই সকলেরই উচিত এই রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারনা রেখে সঠিক ভাবে জীবনযাপন করা, ঠিক মতো চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া এবং ব্যায়াম খাদ্যাভাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
রেফারেন্সঃ
লিখেছেন:
ইশরাত জাহান ইশিতা
বিভাগঃ ফার্মেসি
সেশনঃ২০১৯-২০
মাভাবিপ্রবি
খুব প্রয়োজনীয় তথ্য!!
ধন্যবাদ আপনাকে 💓
Congratulations 💓
অনেক সুন্দর ছিল লেখাটি।
Very nice article
Brilliant gesture 🖤
অনেক সুন্দর, তথ্য বহুল লিখা।যা পড়ে অনেকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে পারবে এবং ডায়বেটিস কে ভয় না পেয়ে সঠিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করে এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারবে
অনেক সুন্দর লেখনী
Sundr❤️
👍👍👍👍👍👍