সেরিব্রাল পালসি (সিপি)

প্রাথমিক চিকিৎসা ফার্মা সংবাদ বিবিধ মানসিক স্বাস্থ্য রোগব্যাধি

সেরিব্রাল পালসি (সিপি) হলো এক ধরনের স্নায়বিক ভারসাম্যহীনতা যা বাচ্চাদের উন্নয়নশীল মস্তিষ্কের আঘাত বা বিকৃতির কারণে ঘটে। এটি মূলত দেহের অংশ, পেশী বা ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নড়াচড়া, পেশীর সক্ষমতা, কোওর্ডিনেশন বা ভারসাম্য সব কিছুই ব্যাহত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের প্রতি ৩২৩ জন জীবিত শিশুর মধ্যে একজন সেরিব্রাল পালসি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বা জন্মের পর আক্রান্ত হয়। আরেক সমীক্ষার তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭,৬৪,০০০ জনগণ এই সমস্যায় ভুগছেন।

কারণ

সঠিক কি কারনে বাচ্চাদের মধ্যে এটি দেখা যায় তা এখন পর্যন্ত অজানা। চিকিৎসকদের মতে, প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থায় মস্তিষ্কের আঘাত শিশুকে সেরিব্রাল পালসির দিকে ঠেলে দেয়।

তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময় অনুযায়ী এর কারণগুলোকে ভাগ করা যায়:

১. জন্মের আগে

  • গর্ভাবস্থায় প্রসূতি অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন করলে কিংবা প্রয়োজনীয় ফলিক এসিড গ্রহণ না করলে।
  • গর্ভাবস্থায় প্রসূতির বিভিন্ন অসুস্থতা থাকলে। যেমন – হাম, অনিয়ন্ত্রিত বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি।

২. জন্মের সময়

  • অপরিণত অবস্থায় শিশু ভূমিষ্ঠ হলে।
  • প্রসবের সময় মস্তিষ্কে আঘাত পেলে।
  • জন্মের পর শিশুটি স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারলে।

৩. পরবর্তী সময়ে

  • মস্তিষ্কের সংক্রমণজনিত ব্যধিতে আক্রান্ত হলে। যেমন – মেনিনজাইটিস।
  • কোনো দুর্ঘটনায় মাথায় তীব্র আঘাত পেলে।

কত প্রকার হতে পারে

সাধারণত চার ধরনের সেরিব্রাল পালসি হয়ে থাকে:

১. স্প্যাস্টিক সেরিব্রাল পালসি: অধিক সংখ্যক বাচ্চার ক্ষেত্রে এটি দেখা যায় যদিও রোগের প্রখরতা সব সময় এক নাও হতে পারে। এই প্রতিবন্ধকতার আবার চারটি ভাগ আছে।

ক. মনোপ্লেজিয়া: কেবল একটি হাত কিংবা একটি পা-ই আক্রান্ত হয়।

খ. ডাইপ্লেজিয়া: দুটো পা বা দুটো হাত সমানভাবে আক্রান্ত হয়।

গ. হেমিপ্লেজিয়া: শরীরের একই পাশের (শুধু বাম অথবা ডান পাশ) হাত ও পা আক্রান্ত হয়।

ঘ. কোয়াড্রিপ্লেজিয়া/টেট্রাপ্লেজিয়া: দুই পা এবং দুই হাত, এই চারটি অঙ্গই সমানভাবে আক্রান্ত হয়।

২. আথেটয়েড বা ডিস্‌কাইনেটিক সেরিব্রাল পালসি: পেশীর গঠন ও চলাচল খুবই কম। মাথা, হাত ও পায়ের অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনি। যা বিশেষ মূহুর্তে কমে বা বাড়ে।

৩.আটাক্সিক সেরিব্রাল পালসি: খুব কম দেখা যায়। বৈশিষ্ট্য হল দুর্বলতা, চলাফেরার অসুবিধা। ব্যাপক অর্থে, ফাইন মোটর স্কিলের অসুবিধা ও চলাফেরার সমস্যাটাই এখানে প্রধান।

৪. মিশ্র অবস্থা: বিভিন্ন ধরণের সেরিব্রাল পালসির সমন্বয়; যদিও স্প্যাসটিসিটি ও আথেটোসিস এই দুই প্রকারের সমন্বয়ই বেশি দেখা যায়।

সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ:

একটা শিশুর জন্মের সাথে সাথে লক্ষণ বুঝা যায় না। সাধারণত এটি বুঝতে পারা যায় শিশুটির ২-৩ বছর বয়সে। লক্ষণ গুলো হচ্ছে-

১। শিশুর ধারাবাহিক উন্নতির বিলম্ব ঘটে। যেমন- ৮মাস বয়সে বসা অথবা ১৮ মাস বয়সে দাঁড়াতে পারবে না।

২। শিশুটিকে গম্ভীর অথবা নিস্তেজ দেখায়।

৩। বাহু অথবা পা দূর্বল থাকে।

৪। মাংসপেশির সংকোচন।

৫। হাত অথবা পা কাঁপা।

৬। সর্বদা এলোমেলোভাবে চলাফেরা।

৭। একনাগাড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাফেরা।

৮। এ সময়কালে অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যেমন- খাদ্য গলাধঃকরনে সমস্যা, কথা বলতে সমস্যা, কোন কিছু দেখতে সমস্যা এবং পড়ালেখার অক্ষমতা।

পরীক্ষা – নিরীক্ষা :

ব্রেন স্ক্যান সেরিব্রাল পালসি নিশ্চিত হতে সহায়তা করে। এ জন্য ব্রেনে কয়েকটা স্ক্যান করতে হতে পারে যেমন- আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান, MRI স্ক্যান, CT স্ক্যান। এছাড়াও EEG, EMG, Blood test উল্লেখযোগ্য।

চিকিৎসা পদ্ধতি :

ডাক্তার লক্ষণ বা উপসর্গগুলি পরীক্ষা করে শিশুর মূল্যায়ন করে। শিশুটিকে একটি শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ স্নায়ু চিকিৎসকের কাছে পাঠানো যেতে পারে। নির্দিষ্ট কোন ওষুধ নেই। কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসা রোগীকে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে সহায়তা করে।

শিশুর জীবনযাত্রার মান ভালো করতে বিভিন্ন ব্যাবস্থা রয়েছে। যেমন –

১। ফিজিওথেরাপি

২। অকুপেশনাল থেরাপি

৩। স্পীচ থেরাপি

৪। বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড

৫। পুষ্টি ও খাদ্যতালিকা নিয়ন্ত্রণ

এছাড়া মেডিকেশন এবং সার্জারীর মতো চিকিৎসা নেয়া যেতে পারে।

প্রতি বছর ৬ অক্টোবর “বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি” দিবস পালিত হয়। এই বিশেষ দিনটি উদযাপনের লক্ষ্য হলো আক্রান্ত মানুষদের সমান অধিকার ও সুস্থ জীবন যাপন নিশ্চিত করা। সার্বিকভাবে রোগ মনে হলেও এটি আসলে কোনো ব্যাধি নয়, এটি এক ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা অসামঞ্জস্যতা। আমাদের আশেপাশের প্রতিটি মানুষের একটু আন্তরিকতা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গী নিশ্চিত করতে পারে একটি শিশুর সহজ ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা।

Reference:

লিখেছেন:

Zakia Ferdous Humaira

Department of pharmacy ( 3rd year), Mawlana Bhashani Science & Technology University

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *