ক্যান্সারের চিকিৎসায় ন্যানোপার্টিকেল ভিত্তিক ঔষধ সরবরাহের গুরুত্ব

রোগব্যাধি স্বাস্থ্য সংবাদ

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এবং গবেষণা খাতে নতুন নতুন যৌগ তৈরিতে ন্যানো প্রযুক্তি একটি দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। এটি অভিনব এক প্রযুক্তি যা জৈব রাসায়নিক সিস্টেমের বিকাশ এবং অনুসন্ধানের জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছে।
ন্যানোপার্টিকেল ভিত্তিক ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম এক ধরণের প্রকৌশলী প্রযুক্তি যা দেহে ঔষধের সঠিক এবং নিয়ন্ত্রিত সরবরাহ নিশ্চিত করে। এই আধুনিক ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেমটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ডোজের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে যা খুবই গ্রহণযোগ্য। ন্যানোপার্টিকেলের বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একে অন্য সকল ড্রাগ ডেলিভারি
সিস্টেম হতে আলাদা করেছে। যেমন- ন্যানোপার্টিকেলের আকার অনেক ছোট কিন্তু সারফেস এরিয়া বেশি এবং সহজেই আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে এবং জৈব যৌগের সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি, তাই সহজেই কোষঝিল্লি অতিক্রম করে ব্লাড ছারকুলেশনে যেতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ইফেক্ট দেখাতে পারে।
বিভিন্ন ধরণের ন্যানোপার্টিকেলঃ
হাইড্রোজেলঃ
এটি এক ধরণের ন্যানোপার্টিকেল যার প্রাচীর লিপিড জাতীয় পলিস্যাকারাইড দ্বারা তৈরি এবং এটি দ্বারা ঔষধ, প্রোটিন এবং ভ্যাকসিন এন্টিজেন এনক্যাপসুলেশন করে ব্যবহার করা হয়।
লিপোসোম জাতীয় ন্যানোপার্টিকেলঃ এটি এক ধরণের গোলাকৃতির ন্যানোপার্টিকেল যার ভেতরে লিপিড জাতীয় ড্রাগ থাকতে পারে। কিন্তু বাইরের শেল হাইড্রোফিলিক জাতীয় হওয়ায় সহজেই লিপিড জাতীয় ড্রাগ রক্তে পরিবাহিত হতে পারে।
ডেনড্রাইমারঃ এটি বহু শাখাবিশিষ্ট গোলাকৃতির বায়োডিগ্রেডেবল কৃত্রিম পলিমার যৌগ যা একটি ফোম বলের মতো দেখায়। ডেনড্রাইমারের মধ্যে ফাঁকা জায়গা, এর পরিবর্তন/প্রস্তুতির সহজতা এবং আকার নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যযুক্ত জিন এবং ওষুধ সরবরাহের জন্য দুর্দান্ত সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
পলিমারোসোমঃ এটি ফাঁপা শেলবিশিস্ট ন্যানোপার্টিকেল যা টিউমারের অম্লীয় পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধ সরবরাহ করতে পারে।
ন্যানোটিউবঃ ন্যানোটিউব হল টিউবে সাজানো একক বা বহু প্রাচীরযুক্ত কার্বন পরমাণুর সমাহার যা সাধারণত মনোক্লোনাল এন্টিবডি, কিলেটস্ এবং ফ্লোরোসেন্ট প্রোব দ্বারা তৈরী হয়ে থাকে। ন্যানোটিউবগুলির একটি জনপ্রিয় রূপ হল ফুলেরিনের দ্রবণীয় ডেরিভেটিভ যেমন C-60 যা টিউমার ধ্বংসকারী ফার্মাসিউটিক্যাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ন্যানোটিউবগুলির অভ্যন্তরীণ বিশাল আয়তন এবং বাহ্যিক পৃষ্ঠটি সহজেই কার্যকরী করা যেতে পারে।

মোডিফাইড ব্যাকিবলঃ ক্যান্সার কোষগুলোতে তেজস্ক্রিয় মৌল সরবরাহে এটি সহায়তা করে। আরও কিছু ন্যানোপার্টিকেলগুলো হলোঃ পলিমার ন্যানোপার্টিকেল, ন্যানোক্রিস্টাল, সিরামিক ন্যানো পার্টিকেল, গোল্ড ন্যানোপার্টিকেল, কোয়ান্টাম ডটস্, ন্যানোইরাইথ্রোসোম ইত্যাদি।

চিকিৎসাক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারঃ
ক্যান্সারঃ

বর্তমানে সারাবিশ্বে ক্যান্সার মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু সাধারণ কেমোথেরাপি গুলো অধিক ক্ষতিকর, বিষক্রিয়াযুক্ত,এবং বেশী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যুক্ত হয়ে থাকে। ক্যান্সার রোগীকে অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হয় এবং সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সময় পার করতে হয়, কিন্তু ন্যানোপার্টিকেলের ব্যবহার এই অবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসায় ঔষধগুলোর কার্যকরীতা বৃদ্ধির জন্য ন্যানোটেকনোলজি অনেক ভূমিকা রাখতে পারে। এর মাধ্যমে বিষক্রিয়া কমানো যায়, অ্যান্টি-ক্যান্সার ঔষধের নির্ভুলতা বৃদ্ধি করা যায়, বেশি টিউমার কোষ ধ্বংস করা যায়, এবং কোষের দ্বারা ঔষুধ এনগাল্ফ করাও সহজ হয়। ক্যান্সার চিকিৎসায় ন্যানোপার্টিকেল, লিপোসোম, ডেনড্রাইমার, মিসেলস ইত্যাদি বাহক হিসেবে কাজ করে। এইসব বাহক দ্বারা বিভিন্ন কেমোথেরাপিউটিকস সহজেই ‘ব্লাড ব্রেইন ব্যারিয়ার’ (বিবিবি) সহ অন্যান্য ঝিল্লীর মধ্য দিয়ে স্থানান্তর করা যায়। ক্যাটায়নিক ন্যানোস্ফেয়ার, পলিমার ইত্যাদি ন্যানোপার্টিকেল দ্বারা জিন থেরাপির ঔষধগুলোকে আরও মোডিফাই করা সম্ভব।
ফুসফুসের ক্যান্সারে রোগ-নির্ণয়, ইমেজিং, স্ক্রিনিং এবং প্রাথমিক ও মেটাস্টাটিক টিউমারগুলোর চিকিৎসায় ন্যানোপার্টিকেল ভিত্তিক ড্রাগ ডেলিভারী খুবই কার্যকরী। এক্ষেত্রে লিপিড ন্যানোক্যারিয়ার, পলিমারিক ন্যানোপার্টিকেল, ডেনড্রাইমার, মেটাল ন্যানোপার্টিকেল ইত্যাদি বাহক হিসেবে কাজ করে। ১০-১০০ ন্যানোমিটারের ন্যানোপার্টিকেলগুলো ক্যান্সার থেরাপিতে
উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়। কার্বন ন্যানোটিউব ব্রঙ্কিয়াল এজমার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সার চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপি নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে। আ্যান্টি-টিউমার ইমিউন রেসপন্সকে সক্রিয় করার মাধ্যমে ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপি কাজ করে। ন্যানোপার্টিকেল ভিত্তিক ইমিউনো থেরাপির মধ্যে ন্যানোভ্যক্সিন, আর্টিফিসিয়াল আ্যান্টিজেন-প্রেজেন্টিং সেল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

মেটাবলিক এবং অটো-ইম্মিউন রোগঃ
মেটাবলিক ও অটোইম্মিউনো রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস এবং অস্টিওপোরোসিস অন্যতম। ন্যানোপার্টিকেলের ব্যবহার এসব রোগের চিকিৎসায় সঠিক এবং নির্দিষ্ট মাত্রায় ধীরে ধীরে ঔষধ সরবরাহের জন্য ভূমিকা রাখতে পারে। ন্যানোপার্টিকেলের ব্যবহার মিউকাস দ্বারা ঔষধ শোষণ বৃদ্ধি করতে পারে এবং ঔষধের অপচয় রোধ করতে পারে।

কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রোগঃ
প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা দ্বারা সহজে মস্তিষ্কের রোগ দূর করা যায় না কারণ সাধারণত ঔষধ ‘ব্লাড ব্রেইন ব্যরিয়ার’, করয়েড প্লেক্সাস ইত্যাদি সহজে অতিক্রম করতে পারে না। ন্যানোপার্টিকেল এবং লাইপোসোম দ্বারা মোডিফাইড ঔষধগুলো সহজে এবং নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মস্তিস্কে সরবরাহ করা সম্ভব।
রোগ নির্ণয়ে ন্যানোপার্টিকেলঃ
ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে উন্নত ফ্লোরোসেন্ট মার্কার তৈরি করা সম্ভব। সাধারণ ফ্লোরোসেন্ট মার্কার যেগুলো রোগ-নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় তাদের ক্ষেত্রের একই রঙের লেজার প্রয়োজন এবং এগুলো সহজেই ঝড়ে পরে এবং অনেকক্ষেত্রে একাধিক ডাই একসাথে করলে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু, ফ্লোরোসেন্ট ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে এসব অসুবিধা দূর করা যায়।
আ্যন্টি-মাইক্রোবিয়াল রেসিস্ট্যান্টঃ
অনুজীবের বিরুদ্ধে আ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল ঔষধের এত সাফল্য থাকা সত্ত্বেও এসব ঔষধ রেসিস্ট্যান্ট হয়ে যাওয়া একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। থেরাপিউটিক ন্যানোপার্টিকাল যেমন লিপোসম, পলিমারিক ন্যানোপার্টিকাল, ডেনড্রাইমার, অজৈব ন্যানোপার্টিকেল ইত্য্যাদির ব্যবহার লোকাল আ্যন্টিবায়োটিক চিকিৎসায় এবং আ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট হ্রাস-করণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
উপসংহারঃ
ন্যানোপার্টিকাল ভিত্তিক ঔষধ সরবরাহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি সম্ভাবনায় আবিষ্কার যার দ্বারা বিভিন্ন রোগ-বিশেষ করে ক্যান্সার নির্ণয়, শনাক্তকরণ, ইমেজিং ইত্যাদি সম্ভব। বিভিন্ন ইনফেকশন চিকিৎসায় আ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহারের অতীব সম্ভাবনা রয়েছে। ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন নতুন ক্ষেত্রের সূচনা হচ্ছে। পরিশেষে বলা
যায়, ন্যানোপার্টিকেল ভিত্তিক থেরাপির সঠিক বিস্তার সম্ভব হলে ভবিষ্যতে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নতির শিখরে পদার্পণ করতে পারবে যা মানবকল্যাণের অভাবনীয় দৃষ্টান্তস্বরুপ হতে পারে।

Reference:
Singh, R., & Lillard, J. W. (2009). Nanoparticle-based targeted drug delivery. Experimental and
Molecular Pathology, 86(3), 215–223. doi:10.1016/j.yexmp.2008.12.004
Emerich, D. F., & Thanos, C. G. (2007). Targeted nanoparticle-based drug delivery and diagnosis.
Journal of Drug Targeting, 15(3), 163–183. doi:10.1080/10611860701231810

Yao, Y., Zhou, Y., Liu, L., Xu, Y., Chen, Q., Wang, Y., … Shao, A. (2020). Nanoparticle-Based Drug
Delivery in Cancer Therapy and Its Role in Overcoming Drug Resistance. Frontiers in Molecular
Biosciences, 7. doi:10.3389/fmolb.2020.00193
Yan, L., Shen, J., Wang, J., Yang, X., Dong, S., & Lu, S. (2020). Nanoparticle-Based Drug Delivery
System: A Patient-Friendly Chemotherapy for Oncology. Dose-Response, 18(3),
155932582093616. doi:10.1177/1559325820936161
Galvin, P., Thompson, D., Ryan, K.B. et al. Nanoparticle-based drug delivery: case studies for cancer
and cardiovascular applications. Cell. Mol. Life Sci. 69, 389–404 (2012). https://doi.org/10.1007/s00018-
011-0856-6
Babu, A., Templeton, A. K., Munshi, A., & Ramesh, R. (2013). Nanoparticle-Based Drug Delivery for
Therapy of Lung Cancer: Progress and Challenges. Journal of Nanomaterials, 2013,
1–11. doi:10.1155/2013/863951
Gao, W., Chen, Y., Zhang, Y., Zhang, Q., & Zhang, L. (2018). Nanoparticle-based local antimicrobial
drug delivery. Advanced Drug Delivery Reviews, 127, 46–57. doi:10.1016/j.addr.2017.09.015
Patel, S., Singh, D., Srivastava, S., Singh, M., Shah, K., Chauahn, D. and Chauhan, N. (2017).
Nanoparticles as a Platform for Antimicrobial Drug Delivery. Advances in Pharmacology and Pharmacy,
5(3), pp.31-43. doi:10.13189/app.2017.050301
Patra, J. K., Das, G., Fraceto, L. F., Campos, E. V. R., Rodriguez-Torres, M. del P., Acosta-Torres, L. S.,
… Shin, H.-S. (2018). Nano based drug delivery systems: recent developments and future prospects.
Journal of Nanobiotechnology, 16(1). doi:10.1186/s12951-018-0392-8
Yu, X., Trase, I., Ren, M., Duval, K., Guo, X., & Chen, Z. (2016). Design of Nanoparticle-Based
Carriers for Targeted Drug Delivery. Journal of Nanomaterials, 2016, 1–15. doi:10.1155/2016/1087250
Nanoparticle drug delivery – Wikipedia
Slideshare.net. 2021. Newer drug delivery systems. [online] Available at:
<https://www.slideshare.net/drashutoshtiwari/newer-drug-delivery-systems> [Accessed 1 November
2021].

লিখেছেনঃ
Mehedi Hasan Shahed
Department of Pharmacy (4th Year)
Mawlana Bhashani Science and Technology University

5 thoughts on “ক্যান্সারের চিকিৎসায় ন্যানোপার্টিকেল ভিত্তিক ঔষধ সরবরাহের গুরুত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *