৷৷সংক্রামক রোগ মাংকিপক্স, মহামারী’র নতুন ঢেউ?।।

রোগব্যাধি

মাংকিপক্স ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ানো মাংকিপক্স রোগটি অনেকটা জলবসন্তের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সম্প্রতি এই রোগের প্রাদুর্ভাব অস্বভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত। এটি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর দেহে ছড়িয়ে থাকে। এ রোগের প্রধান লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর,মাথাব্যাথা,পেশীতে ব্যাথা, লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া এবং ক্লান্ত বোধ করা ইত্যাদি। উপসর্গের সময়কাল সধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ হয়ে থাকে।

রোগটি বিভিন্নভাবে ছড়াতে পারে। বন্যপ্রাণীর মাংস,পশুর কামড় বা আঁচড়,শরীরে তরল,দূষিত বস্তু বা সংক্রামিত ব্যাক্তির সাথে ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে সাধারণত ছড়ায়। সর্বপ্রথম ভাইরাসটি আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয় পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার রেইন ফরেস্টের কেউ একজন সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে আসে এবং ভাইরাসটি তার থেকে ছড়ায়। ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক হল বন্যপ্রানী,আর বানরের চেয়ে ইঁদুর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করেছেন গবেষকরা। বানর ছাড়াও ভাইরাসটি গাম্বিয়ান পাউচড ইঁদুর ( ক্রিসোটোসিস গ্যাম্বিয়ান ),ডার্মিস ( গ্রাফিউরাস এসপিপি ) এবং আফ্রিকান কাঠবিড়ালি বাহক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এসব প্রানীর মাংস ভক্ষণ সংক্রমনের অন্যতম কারণ হতে পারে।

১৯৫৮ সালে প্রিবেন ভন ম্যাগনাস কাঁকড়াভুক বানর হতে সর্বপ্রথম ভাইরাসটি শনাক্ত করেন। বানরটিকে মূলত নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য ব্যাবহার করা হতো। সর্বপ্রথম মানুষের মাঝে এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয় ১৯৭০ সালে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে প্রায় ৫০ জন ব্যাক্তির দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়,যাদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল ডেমোক্রেটিক রিপালিক অব কঙ্গোর অধিবাসী। ১৯৮৬ সালের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন মানুষের দেহে এ রোগ শনাক্ত করা হয়।দিন দিন মাংকিপক্সের আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০১১ থেকে ২০১৪ সালে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০০। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তির তথ্য অসংরক্ষিতও থেকে যায়। আফ্রিকার বাইরেও বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। নাইজেরিয়াতে ২০১৭ সালের সেপ্টম্বের মাস থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বপ্রথম যুক্ত্যরাজ্যে মাংকিপক্সের রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৯ সালের ৮ মে সিঙ্গাপুরে ৩৮ বছর বয়সী এক ব্যাক্তিকে শনাক্ত করা হয়,যিনি আক্রান্ত হওয়ার আগে নাইজেরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে আবারো নতুন করে মাংকিপক্সে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ৬ মে ২০২২ সালে তাকে শনাক্ত করা হয় এবং কিছুদিন আগেই তিনি নাইজরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন যেখানে রোগটির ব্যাপক বিস্তার রয়েছে।

মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকে আক্রমনকারী মাংকিপক্স মূলত অর্থোপক্সিভাইরাস গনের পক্সিভিরিডি গোত্রের ডবল স্ট্র্যেন্ডেড ডিএনএ ভাইরাস। ভাইরাসটি সূক্ষ্ম ক্ষতস্থান অথবা চোখ,নাক বা মুখের মিউকাস মেমব্রেনের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত কোন প্রণীর কামড় বা আঁচড় দিলে প্রাণী হতে মানুষে এ রোগটি সংক্রমিত হয়। সংক্রমনের ১০-১৪ দিন কোন লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ভাইরাসটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শুধুমাত্র ত্বকের সংক্রমণ এবং ফুসকুড়ি দেখে এ রোগ নির্ণয় করা যাবে না। অসুস্থতার প্রড্রোমাল পর্যায়ে লিম্ফোডেনোপ্যাথি মাংকিপক্সকে গুটি বসন্ত বা চিকেনপক্স থেকে আলাদা করে। ত্বকের ক্ষত থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন ( পিসিআর ) পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে। তবে এটি এতটা নির্ভরযোগ্য নয়। পিসিআর রক্ত পরীক্ষা সাধারণত অনিশ্চিত কারণ ভাইরাস রক্তে বেশি সময় থাকে না। পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে জ্বর শুরু হওয়ার তারিখ, নমুনা সংগ্রহের তারিখ, ফুসফুসকুড়ির বর্তমান পর্যায় এবং রোগীর বয়স ইত্যাদি তথ্যের প্রয়োজন হয়।

গুটি বসন্তের টিকা মাংকিপক্স প্রতিরোধে সক্ষম বলে ধারণা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন গুটিবসন্তের টিকা ৮৫% কার্যকারিতা সহ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। ২০১৯ সালে জিনিওস নামে একটি মাংকিপক্স ভ্যাকসিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য অনুমোদিত হয়েছিল। চিকিৎসার জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে টেকোভিরিম্যাট নামের একটি অ্যান্টিভাইরাল যা বিশেষত গুটি বসন্ত এবং মাংকিপক্সের মতো অর্থোপক্সভাইরাস গুলির সংক্রমণের জন্য অনুমোদিত। আফ্রিকায় পূর্বে গুটি বসন্তের টিকা গ্রহণ করেছে এমন লোকজনের মাঝে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি কম। ইউনাইটেড স্টেটস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রভেনশান ( সিডিসি ) মনে করে যে মাংকিপক্সের প্রাদুর্ভাব তদন্তকারী এবং সংক্রমিত ব্যাক্তি বা প্রাণিদের যত্ন নেওয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মাংকিপক্সের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য একটি গুটিবসন্ত টিকা গ্রহণ করা উচিত। যে সকল ব্যক্তি বা প্রাণীর সাথে ঘনিষ্ঠতা বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে তাদেরও টিকা দেওয়া উচিত। সিডিসি সুপারিশ করে যে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা একজন সংক্রমিত ব্যক্তির যত্ন নেওয়ার আগে ব্যাক্তগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ( পিপিই ) সম্পূর্ণ সেট ব্যাবহার করা উচিত। এর মধ্যে একটি গাউন, মাস্ক, গগলস এবং একটি ফিল্টারিং ডিসপোজেবল রেসপিরটরস ( যেমন N95 ) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একজন সংক্রমিত ব্যক্তিকে অন্যদের সম্ভাব্য যোগাযোগ থেকে দূরে রাখার জন্য অন্তত একটি ব্যক্তগত পরীক্ষার কক্ষে বিচ্ছিন্ন রাখা উচিত।

লেখকঃ মিম আক্তার,

৭ম ব্যাচ, সেশনঃ ২০১৯-২০।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *