বিশ্বে নারীদের ক্যান্সারের মধ্যে ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার এক নম্বরে আছে। উন্নত বিশ্বে নিয়মিত স্ক্রিনিং আর সচেতনতার কারণে একদম প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার ধরা যায়।কিন্তু বাংলাদেশে এই চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে বাংলাদেশের নারীরা যেখানে প্রকাশ্যে স্তন শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না, সেখানে শরীরে প্রাথমিক কোন লক্ষণ দেখা গেলেও তারা গোপন রাখেন সেসব, যে কারণে বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন একেবারে শেষ পর্যায়ে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে ৯৮ শতাংশের বেশি নারী, তবে খুব অল্প সংখ্যক পুরুষও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ এ রোগে মারা যান।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের হারও।
স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, সেই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়।সেটি রক্তনালীর লসিকা (কোষ-রস) ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যান্সার। চলুন জেনে নেই স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি কিঃ
১) স্তনে চাকা ও লাম্প বা পিন্ড অনুভব করা যা ব্যথাহীন ও খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে আকারে।
২) স্তনের ত্বকে বিভিন্ন পরিবর্তন যেমন চামড়া কুঁচকে যাওয়া, কমলার খোসার মত ছোট ছোট ছিদ্র দেখা দেয়া, চামড়ায় টোল পড়া, দীর্ঘস্থায়ী ঘা ইত্যাদি।
৩) নিপল (বোঁটা) দিয়ে রস নিঃসরণ হওয়া বা রক্তপাত হওয়া।
৪) নিপল ও তার আশেপাশের (Areola) কালো অংশা ফুঁসকুড়ি ও চুলকানি হওয়া।
৫) স্তনে দীর্ঘদিন ব্যথা অনুভূত হওয়া।
৬) স্তনের আকার পরিবর্তন হওয়া।
৭) গলার কাছে অথবা বগলে চাকা অনুভব করা।
৮) স্তনের বোটা ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া অথবা বোটা দিয়ে পুঁজ নির্গত হওয়া।
স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে পরীক্ষা-পদ্ধতিঃ
সাধারণত বয়স ৩০ বা ৩৫ হবার পর সব নারীর উচিত নিয়মিত নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখা। এজন্য মূলত তিনটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে।
• ম্যামোগ্রাম বা বিশেষ ধরনের এক্স রে, যার সাহায্যে স্তনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ধরা পড়ে।
• সুনির্দিষ্ট নিয়মে চাকা বা পিণ্ড আছে কিনা, চিকিৎসকের মাধ্যমে সে পরীক্ষা করানো।
• নিজে নিজে নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী স্তন পরীক্ষা করা।বাম হাত দিয়ে ডান পাশের ও ডান হাত দিয়ে বাম পাশের স্তন পরীক্ষা করা।এই পরীক্ষা করার সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সম্পূর্ণ স্তনটি পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে নিপল থেকে শুরু করে বৃত্তাকারভাবে বাহিরের দিকে যেতে হবে অথবা উপর-নিচ করে সম্পূর্ণ স্তন পরীক্ষা করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সকল টিস্যু (চামড়া থেকে স্তনের নিচের বুকের খাঁচা পর্যন্ত) অনুভব করা হয়। চামড়া ও চামড়ার অল্প নিচের অংশের জন্য অল্প চাপ দিতে হবে, স্তনের মাঝের অংশের জন্য মাঝারি চাপ দিতে হবে ও স্তনের নিচের অংশ অনুভবের জন্য গভীরভাবে চাপ দিতে হবে।
স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়ঃ
১.ক্যান্সার প্রতিরোধী খাবার খাওয়া
ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমাতে ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবারের ভূমিকা অনেক বেশি,যা ক্যান্সারের সম্ভাবনা ৬০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। আর এই জন্য তাজা ফল, মটরশুঁটি, ফ্ল্যাভনয়েড, আস্ত শস্য এবং ক্রুসিফেরাস ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট (যেমন ব্রোকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি) ও ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ সবজিগুলো খেতে হবে। এখানে পেঁয়াজ পাতা, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করে।
তবে সবচেয়ে ভালো ফল পেতে হলে এই ধরনের সবজি কাঁচাই খেয়ে ফেলতে হবে। সয়াবিন, সয়া প্রোটিন ও অন্য সয়া পণ্য যেমন আমাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিও অনেক কমায়।
২.শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারীরা নিয়মিত ৩০-৪০ মিনিট ব্যায়াম বা ইয়োগা করেন তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ২৫-৪৫% কমে যায়। তাই অবশ্যই প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সময় করে যেকোনো ব্যায়াম করতে হবে। আর সেটাও সম্ভব না হলে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করতে হবে।
৩.ওজন ঠিক রাখা
বাড়তি ওজন অন্যান্য রোগের পাশাপাশি স্তন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। যারা নিয়মিত ব্যায়াম বা ডায়েট করে না তাদের ওজন খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার ফলে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে দেহের স্বাভাবিক ওজন ঠিক রাখা জরুরি।
৪.গ্রিনটি পান করা
প্রতিদিন কমপক্ষে এক কাপ গ্রিনটি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করবে।
৫.ভালো ফ্যাট গ্রহণ করা
ওমেগা-৩, ভুট্টা, সূর্যমুখীর তেল এইসব ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার বা খারাপ ফ্যাট যুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এইসকল ফ্যাট বা বিভিন্ন ধরণের চর্বি স্তন ক্যান্সারের উপর অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে। তাই মাছের তেল এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
৬.ধূমপান বর্জন করা
যেসব নারীর ধূমপানে আসক্ত বা অ্যালকোহল সেবনের অভ্যাস আছে,তাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৩০% থেকে ৪০% এরও বেশি থাকে। তাই এই অভ্যাসগুলো থাকলে আজই পরিত্যাগ করার চেষ্টা করতে হবে।
৭.নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট
অনেক সময় খাবারে পরিমিত পুষ্টি, ভিটামিন ও মিনারেল নাও পেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। যা স্তন ক্যান্সার সহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। তাই চেষ্টা করতে হবে পর্যাপ্ত মাত্রায় ভিটামিন এ, ডি ও ই সমৃদ্ধ খাবার বা সাপ্লিমেন্ট খেতে। যা স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তথ্যসূত্রঃ
১. bbc.com
২. shajgoj.com
লেখকঃ সিনজানা সিদ্দিকা
বিভাগঃ ফার্মেসী
সেশনঃ ২০১৭-২০১৮